চারদিকে নাগিনীদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস, বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে : মির্জা ফখরুল
প্রকাশিতঃ ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
সোনার বাংলা ৭১ রিপোর্ট, গোপালগঞ্জে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী ও রওশন আরা রত্নাসহ নেতা-কর্মীদের ওপর নৃশংস হামলা, সংগঠনের কেন্দ্রীয় ক্রীড়া সম্পাদককে হত্যার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, চারদিকে নাগিনীদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস, তারা বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তারা পরিষ্কার করে বলতে চাচ্ছে, এখনো হায়নারা (আওয়ামী লীগ) লুকিয়ে আছে, যেকোনো সময় আক্রমণ করবে। হায়নাদের আক্রমণকে আমাদের প্রতিহত করতে হবে।
এ সময় নেতা-কর্মীদের কোনোভাবেই ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তে পা না দেয়ারও আহ্বান জানান তিনি।
শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণসভায় বক্তব্যকালে তিনি এ কথা বলেন। এই স্মরণ সভার আয়োজন করে বিএনপি।
মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের মানুষ সবসময় আত্মত্যাগ ও প্রাণ দিয়েছে। ‘৭১-এ যখন আমরা স্বাধীন হলাম, তখন ভেবেছিলাম সত্যিকার অর্থে আমরা একটা প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশ পাবো। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, যারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার ছিলেন প্রথম তাদের অর্থাৎ আওয়ামী লীগের হাতেই গণতন্ত্র ধ্বংস হয়। ৭৫ সালে তারা একদলীয় বাকশাল কায়েম করে। এ কথা একবার বললে হবে না, বারবার বলতে হবে। এই দলটি আবার ২০০৮ সালে নির্বাচনের পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছে। ছাত্রদের আন্দোলনকে বারবার দমন করতে নির্যাতন, গুম খুন করেছ। এর ফলশ্রুতিতে জুলাই মাসে ও ১৭ বছর এদেশের গণতান্ত্রিক মানুষ জীবন, প্রাণ দিয়েছেন।
আন্দোলনে যারা শহীদ ও আহত হয়েছেন তাদের কথা তুলে ধরে অভিবাদন জানিয়ে তিনি বলেন, স্যালুট জানায় বেগম খালেদা জিয়াকে, গণতন্ত্রের প্রশ্নের তিনি কখনো আপস করেননি, মাথা নোয়াননি। দীর্ঘ ছয় বছর কারাগারে ছিলেন ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি মুক্ত হয়েছেন। সেই সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও অভিবাদন জানান তিনি।
গণঅভ্যুত্থান ও আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে আমরা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পেয়েছি, এই সরকারের কাছেই দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আকাশচুম্বী এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, অর্তর্বতীকালীন সরকারের কাছে আশা, তারা একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এর মাধ্যমে নির্বাচন দিয়ে সত্যিকার অর্থে আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে পারি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ১৬ বছর ধরে যারা পঙ্গু ও নিহত হয়েছেন তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, সরকার প্রধানের কাছে এমন দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব।
১৬ বছর ধরে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনীত দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যে সকল মামলা হয়েছে তা অতিদ্রুত প্রত্যাহার করতে হবে এমন দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জাতির কাছে অঙ্গীকার করতে চাই, সত্যিকার অর্থে প্রকৃত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাব। তবে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে চক্রান্তের মধ্য দিয়ে কেউ যেন আমাদেরকে বিপথের না নিয়ে যায়। কোনো মতেই আমরা যেন আমাদের লক্ষ্য ও পথ না হারাই।
স্মরণ সভায় বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আওয়ামী লীগ দাঁড়ানোর জন্যও একটা মুরগির খোপ পায়নি। আগামী ১০০ বছরও ছাত্র-জনতার কাছে তারা আস্থা পাবে না। ছাত্র-জনতার হত্যাসহ গত ১৫ বছরের গুম-খুন ও নির্যাতনের বিচার হলে আওয়ামী লীগ ‘কবরলীগে’ পরিণত হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদদের রক্তের সাথে কেউ যেন বেইমানি না করে তার জন্য সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
সমাবেশে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্য তাবিখ আউয়াল, ইশরাক হোসেন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল আলম নিরব, সদস্য সচিব আমিনুল হক, দক্ষিণের আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনসহ সহস্রাধিক নেতাকর্মী।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ এবং গুম পরিবারের আর্তনাদ
স্মরণ সভায় শুরুতে জুলাই বিপ্লবে শহীদ ও আহত পরিবার এবং গত ১৫ বছরের গুম-খুন পরিবারের সদস্যদের আর্তনাদে চারপাশ ভারি হয়ে ওঠে। ছাত্র আন্দোলনে সাভারে শহীদ ইয়ামিনের বাবা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ এর থেকে ভাড়ি কোনো বোঝা নেই। আর কোনো বাবা-মা-বোনকে এই নির্মম পরিস্থিতির শিকার যেন না হতে হয়। আমার ছেলেকে পুলিশ সাঁজোয়াযান থেকে টেনে-হেঁচড়ে ফেলে দেয়ার দৃশ্য যেন আর দেখতে না হয়। এমন কোনো ইয়ামিন যেন পুলিশের ঘৃণার পাত্র না হয়। আগামী দিনে পুলিশ যেন তার সঠিক দায়িত্ব পালন করবেন। আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই এবং শহীদের মর্যাদা দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এ সময় তিনি ‘সাঁজোয়াযান’ নিয়ে একটি লিখিত কবিতা পাঠ করেন।
টাঙ্গাইলে গুলিতে দুই চোখ হারানো হিমেলের মা বলেন, তার ছেলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। আমি গরিব মানুষ। গুলিতে আমার ছেলে চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, আমার ছেলে যেন তার একটা চোখ দিয়ে দেখতে পারেন। আমি ন্যায় বিচার চাই।
শহীদ লিটন চন্দ্র শীলের মা রুবি রানী শীল বলেন, আমার ছেলেকে মেরেছে খুনী হাসিনা। আমি বিচার চাই।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের পুলিশের গুলিতে নিহত ইমনের ছোট ভাই সুজন বলেন,‘আমার ভাই টিউশনি করে আমাদের পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি নিজেও পড়াশোনা করেন। গুলিতে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে ফেরত দেয়া হয়। পরে রাত ৩টার দিকে ঢাকায় নিয়ে আসার পথে পুলিশ গাড়ি থামিয়ে আবারো পেটে নির্মম নির্যাতন করেন। আমার ভাই পুলিশের পুলিশের হাত-পা জড়িয়ে ধরলেও তারা ক্ষমা করেননি। আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে, হত্যাকারীদের বিচার যেন দেশের মাটিতে দেখতে চাই। তাদের ফাঁসি চাই।’
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সাবেক বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ বলেন,‘গত ১৫ বছরে স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট খুনী হাসিনা যত গুম খুন হত্যা করেছে, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার বাংলার মাটিতে হবে ইনশাআল্লাহ। সম্প্রতি একটি অডিও রেকর্ড শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি নাকি চট করে বাংলাদেশে ঢুকবেন। আমরাও রেডি আছি, এবার স্বজন হারানোর বেদনার গল্প আমরা আপনাকে শোনাবো।’
এর আগে, দুপুর আড়াইটা থেকেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে পূর্ব ঘোষিত সমাবেশে অংশ নিতে শহীদ মিনারে সামনে জড়ো হতে থাকেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। সমাবেশে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজে নেতা-কর্মীরা কর্মসূচির প্রাঙ্গণে অবস্থান করেন। এ সময় তারা সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগানে সমাবেশ প্রাঙ্গণ মুখরিত করে তোলেন।
এরআগে কর্মসূচিতে অংশ নিতে দুপুর ব্যানার ও ফেস্টুন সহকারে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে জড়ো হতে শুরু করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। সমাবেশের শুরুতে আন্দোলন শহীদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পীরা। আন্দোলন দিনগুলোর ভয়াবহ হামলার চিত্র মঞ্চ নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরেন অভিনয় শিল্পীরা। সবশেষে দলীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে স্মরণসভার সমাপ্তি হয়।