পুলিশের তদন্তে দায়ী পুলিশ, বিচার নিয়ে সংশয়!
প্রকাশিতঃ ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
স্টাফ রির্পর্টাস: টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে ছেলের সামনে মায়ের শ্লীততাহানির জের ধরে পুলিশ-জনতা সংঘর্ষে চারজন নিহতের ঘটনা পুলিশে তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশকেই দায়ী করা হয়েছে। নিহতদের পরিবার তদন্তকে নিরপেক্ষ স্বীকার করছে। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে।
প্রতিবেদনে কালিহাতি ও ঘাটাইল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সহ চার উপ-পরিদর্শক ও তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। টাঙ্গাইলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে টাঙ্গাইল থেকে প্রত্যাহার করার সুপারিশ করা হয়েছে। ঘটনার জন্য কতিপয় পুলিশ সদস্যের অপরিণামদর্শী আচরণ, যথাসময়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের গাফিলতি ও বিরোধী রাজনৈতিক জোটের ইন্দনকে দায়ী করেছে পুলিশের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। পুলিশ ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করলে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনা নাও ঘটতে পারতো বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনার পর পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (শৃঙ্খলা) আলমগীর হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে পুলিশ বিভাগ। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) এবং ঢাকা রেঞ্জ অফিসের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আখতারুজ্জামান। তদন্ত শেষে তারা ৪১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন পুলিশ সদর দপ্তরে জমা দিয়েছে।
পুলিশ বিভাগ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ১৫ সেপ্টেম্বর কালিহাতি উপজেলা সদরের সাতুটিয়া এলাকায় মা ও ছেলেকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। নির্যাতনের শিকার মা ও ছেলে পার্শ্ববর্তী ঘাটাইল উপজলোয় হওয়ায় কালিহাতি ও ঘাটাইলে উভয় এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এলাকাবাসী গত ১৮ সেপ্টেম্বের কালিহাতি থানা ও নির্যাতনকারীদের বাড়ি ঘেরাওয়ের কর্মসূচির আয়োজন করে। ওইদিন বিকাল পৌনে চারটায় ঘাটাইল উপজেলার হামিদপুর বাজারে বিক্ষুব্ধ লোকজন সমবেত হয়। পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করলে তারা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ভাঙচুর শুরু করে। সেখানে কর্তব্যরত ঘাটাইল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুনসুপ আলী তার পিস্তল দিয়ে সাত রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। তার সঙ্গে থাকা অন্য পুলিশ সদস্যরাও উত্তেজিত জনতার উদ্দেশে গুলি বর্ষণ করে। এতে শামীম নামের এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে মারা যান। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে কালিহাতি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকলে নিক্ষেপ শুরু করে। সেখানে কর্তব্যরত কালিহাতি থানার এসআই মোহাম্মদ সলিমউদ্দিন পিস্তল দিয়ে একটি গুলি, কনস্টেবল আমিনুল রাইফেল দিয়ে একটি গুলি, কনস্টেবল জিয়াউল হক ও তমাল চন্দ্র দেব শর্টগান দিয়ে পাঁচটি গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে ফারুক হোসেন, শ্যামল চন্দ্র দাস ও রুবেল হোসেন মারা যান।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কালিহাতি বাসস্ট্যান্ডে পুলিশ সদস্যরা গুলি করলে থানার সাবেক ওসি শহীদুল ইসলাম গুলিবর্ষণের সঠিক সংখ্যা এবং হতাহত ব্যক্তিদের সংখ্যা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, পুলিশ সদস্যদের জন্য বরাদ্দ করা গুলির সংখ্যা ঠিক আছে। আর এ স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বিক্ষোভ হলেও ঘাটাইল থানার সাবেক ওসি মোহাম্মদ মোকলছেুর রহমান তা প্রতিরোধের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করনেনি। তিনি উত্তেজনা প্রশমনে জনসংযোগ করেনি। এমনকি ঘটনাস্থলে অবস্থান না করে থানায় অবস্থান করেন। পরে ভয়াবহতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে যেনতেনভাবে ঘটনাস্থলে হাজির হন। যা তার কর্তব্যে অবহেলা, অদক্ষতা ও উদাসীনতা বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লখে করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে টাঙ্গাইলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার সঞ্জয় সরকার এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মোহাম্মদ শফিকুর রহমান তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছেন উল্লেখ করে বলা হয়, তারা ঘটনার দিন পুলিশ সদস্যদের মোতায়েনের আগে কোনো প্রকার নিদের্শনা দেননি। এছাড়া মা ও ছেলেকে নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না হয়, সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষপে নেননি।
এই দুই র্কমর্কতাকে টাঙ্গাইল থেকে প্রত্যাহার করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি কালিহাতি থানার সাবেক ওসি মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম (বর্তমানে রংপুর অঞ্চলে সংযুক্ত), ঘাটাইল থানার সাবেক ওসি মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান (বর্তমানে খুলনা অঞ্চলে সংযুক্ত), কালিহাতি থানার এসআই আবুল বাশার, ছলিমউদ্দিন, কনস্টেবল আমিনুল ইসলাম, জিয়াউল হক ও তমাল চন্দ্র দেব এবং ঘাটাইল থানার এসআই ওমর ফারুক ও মুনসুপ আলীকে সাময়িক বরখাস্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে। এছাড়া ঘাটাইল থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) হারুন অর রশীদকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বর্পূণ ইউনিটে বদলি করতে বলা হয়েছে।
নিহতদের পরিবারের সদস্যরা জানান, পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে বদলি অথবা সাময়িক বরখাস্ত। পরক্ষণেই তা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর সোনারনাংলা৭১.কমকে বলেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ইতিমধ্যে দোষী প্রত্যেককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এদিকে চারজন নিহতের ঘটনায় সংশি¬ষ্ট ১৩ পুলিশের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। ৭ মার্চের মধ্যে এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে এ বিষয়ে পুলিশের করা দুটি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপনের পর বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত সোমবার এই আদেশ দেন। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।
তদন্ত প্রতিবেদনে ১৩ জন পুলিশের বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তের আদেশসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়। এ সুপারিশ অনুসারে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা ৭ মার্চের মধ্যে আইজিপি আদালতে প্রতিবেদন আকারে জানাবেন। এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য ৯ মার্চ দিন ঠিক করা হয়েছে।
–