কোটি টাকার জমিতে গড়ে উঠছে অবৈধ বসতি
প্রকাশিতঃ ২৭ নভেম্বর, ২০২৪
রেলস্টেশন থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট বীরহলকা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রেললাইনের কোটি টাকার জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। রেলের পরিত্যক্ত জমিতে স্থানীয় ভূমিহীন ও নদীভাঙা মানুষ অবৈধভাবে গড়ে তুলছে বসতবাড়ি।
দীর্ঘদিন ধরে ওই রেলপথে ট্রেন ও মালবাহী ওয়াগন চলাচল না করায় পরিত্যক্ত হয়ে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার রেলপথ, স্লিপারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম।
রেল কর্তৃপক্ষের তদারকি না থাকায় চুরি হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রাংশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৩৮ সালে গড়ে ওঠে বাহাদুরাবাদ ঘাট। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলার সঙ্গে পূর্বাঞ্চল ও ঢাকার যোগাযোগ স্থাপনে যমুনার পূর্বপাড়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট ও পশ্চিম পাড়ে গাইবান্ধার তিস্তামুখ ঘাট নির্মাণ করা হয়। ফেরিতে যাত্রীবাহী ট্রেন ও মালবাহী ওয়াগন পারাপার করা হয়। এতে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানীর দূরত্ব কমে আসে দেড় শতাধিক কিলোমিটার।
যমুনার ভাঙনের ফলে বাহাদুরাবাদ এলাকা থেকে ঘাটটি সরিয়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বড়খালে নেওয়া হয়। সেখানেও ঘাটটি বেশিদিন টেকেনি। পরে ক্রমান্বয়ে ইসলামপুরের কুলকান্দি ও সর্বশেষ দেওয়ানগঞ্জের বীরহলকা ফুটানীবাজার এলাকায় ঘাটটি স্থানান্তর করে রেল কর্তৃপক্ষ। ২০০৭ সালে যমুনা নদীর নাব্য না থাকায় ঘাটটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে পড়ে যাত্রীবাহী ফেরি ও মালবাহী ওয়াগন পারাপার। ফলে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে বীরহলকা এলাকার বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রেলপথ। এর ফলে রেলের জমিতে বসতি গড়ে তোলে নদীভাঙনের শিকার বড়খাল, কেল্লকাটা, বীরহলকা ও চাকুরীয়া গ্রামের কয়েকশ ভূমিহীন।
দেখা যায়, আগের মতো জৌলুস নেই বাহাদুরাবদ ঘাটে। নেই হকারদের হাঁকডাক, যাত্রীর ভিড়। দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাটগামী পরিত্যক্ত রেলপথের দু’ধারে বীরহলকা এলাকায় কয়েকশ বসতি গড়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় রেলপথে মরিচা পড়েছে। স্লিপার চুরি হয়ে গেছে। রেললাইনের ওপরেও বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বাহাদুরাবাদ ঘাটের বিভিন্ন স্থাপনা ও অফিসঘর। যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তাও নষ্ট হওয়ার পথে।
রেল কর্তৃপক্ষের দাবি, দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রেলপথের মূল্য প্রায় কোটি টাকা। রেলের জমির মূল্য কোটি টাকার ওপরে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের পরও রেলের জমি দখল; রেলপথ, স্লিপার ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বীরহলকা গ্রামের মোহাম্মদ হোসেন বলেন, যমুনা তাদের বাড়িঘর, বসতভিটা গ্রাস করেছে। পৈতৃক সূত্রে ১৫ বিঘা জমি পেয়েছিলেন তিনি। সাজানো-গোছানো ছিল ঘরবাড়ি। কিন্তু ১৪ বছর আগে যমুনার ভাঙনে সব বিলীন হয়ে যায়। এখন ওই গ্রামেরই পূর্ব পাশে রেললাইনের ধারে সরকারি জমিতে বসতি স্থাপন করেছেন। তিনি দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন।
কেল্লাকাটা গ্রামের দুদু মিয়া জানান, আবাদি জমি ছিল ৫ বিঘা। সংসারে অভাব ছিল না। জমি চাষ করে ভালোই কাটছিল তাদের জীবন। কিন্তু সর্বনাশা যমুনা সে সুখ কেড়ে নিয়েছে। পরপর ৬ বার বসতভিটা যমুনা নদীতে বিলীন হয়েছে। ৩ বছর ধরে বীরহলকা গ্রামে রেললাইনের পাশে রেলের জমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন।
কেল্লাকাটা গ্রামের শুক্কুর আলীর ভাষ্য, জমাজমি নেই। নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। বাধ্য হয়ে ৩ বছর আগে পরিবার নিয়ে রেললাইনের ধারে বাড়ি করেছেন। পাঁচবার যমুনা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছে তাঁর বসতভিটা। ১০ বিঘা আবাদি জমি ছিল; তাও বিলীন হয়ে গেছে।
বড়খাল গ্রামের শ্যামলের স্ত্রী সুবেশী রাণী জানান, ২০ বছর আগে যমুনা নদীতে তাঁর বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে। তখন থেকে বীরহলকা গ্রামে রেলের জমিতে বসবাস করছেন। এ ছাড়া তাঁর আর বাড়ি করার জায়গা নেই। সরকার তাড়িয়ে দিলে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই বলে কিছু থাকবে না। তাঁর স্বামী দিনমজুরি করেন। জমি কেনার মতো সাধ্য নেই।
বাংলাদেশ রেলওয়ের দেওয়ানগঞ্জ বাজার অফিসের এসএসএই ওয়ে আবু সাঈদের ভাষ্য, দেওয়ানগঞ্জ বাজার থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত রেলপথ দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত, যার মূল্য অন্তত ৮০-৯০ লাখ টাকা। পুরাতন হয়ে মরিচা পড়েছে। নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে।
স্টেশনমাস্টার আব্দুল বাতেন বলেন, দেওয়ানগঞ্জ বাজার রেলস্টেশন থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাটে কোনো ট্রেন চলাচল করছে না। রেলের জমিতে নদীভাঙা মানুষ বাড়ি করে বসবাস করছেন। এ রেলপথে রেলপাত, অন্যান্য যন্ত্রাংশ ও জমি বাবদ কয়েক কোটি টাকার সম্পদ পড়ে আছে। রেলের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিয়মিত তদারকি করছে।