উপজেলা নির্বাচন ঘিরে বাড়ছে সংঘর্ষ মারামারি গুলি হত্যা
প্রকাশিতঃ ২৩ এপ্রিল, ২০২৪
স্টাফ রিপোর্টার,জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সহিংসতা, সংঘাতের রেশ কাটতে না কাটতেই স্থানীয় নির্বাচনকে ঘিরে উত্তপ্ত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত। হঠাৎ করেই আবার শুরু হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রদর্শন। বিজয় নিশ্চিত করতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে অস্ত্র দেখিয়ে অপহরণের ঘটনাও ঘটছে।
বিশেষ করে তুচ্ছ ঘটনায় গুলির শব্দে আতঙ্কিত হচ্ছেন বিভিন্ন এলাকার নানা শ্রেণিপেশার সাধারণ মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পক্ষে অংশ নেওয়া ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই নিজেদের মধ্যে লিপ্ত হচ্ছেন ভয়াবহ সংঘর্ষে। দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি তাদের হাতে দেখা যাচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। গুলিবিদ্ধ হয়ে এরই মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে কাতরাচ্ছেন তাদের অনেকেই। গত ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় কুষ্টিয়ার ফুলবাড়িয়া উপজেলার শিমুলিয়া বাজারে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আতাহার আলী হঠাৎ করেই তার সঙ্গে থাকা পিস্তল বের করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকেন। এতে হাসেম গাজী (৫৫) নামে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ কর্মী এবং রেজাউল হক (৫০) নামে এক ভ্যানচালক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন স্থানীয়রা।
এ ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। অভিযোগে জানা যায়, গত ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচনে নৌকার বদলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ট্রাক প্রতীকের পক্ষে কাজ করায় আতাহার আলীর সঙ্গে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল তাদের। বেশ কিছুদিন ধরে আতাহার আলীর লোকজন হুমকি দিয়ে আসছিল। এই ঘটনার এক দিন আগে ১২ এপ্রিল রাতে অভয়নগরের রাজঘাট বাজারে মোস্তাকের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন খুলনার ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা হেদায়েত হোসেন লিটু ও খায়রুজ্জামান সবুজ। হঠাৎ মোটরসাইকেলে দুজন ওই দোকানে এসে তাদের পিস্তল দিয়ে গুলি করেন। দুজনের পেটে গুলি লাগে। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে দ্রুত খুলনায় নিয়ে যান। দুই বছর আগে লিটুর বড় ভাই মোল্লা হেমায়েত হোসেন লিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তবে অতিসম্প্রতি গত ১৫ এপ্রিল পাঁচ ঘণ্টার ব্যবধানে নাটোরের সিংড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দেলোয়ার হোসেন ও তার ভাইসহ তিনজন অপহরণের ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবীবের নির্দেশনায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়েছিল বলে পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে। অভিযুক্ত লুৎফুল হাবীবের প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন্স, সম্প্রতি অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে প্রতিটি ঘটনায়ই মামলা হচ্ছে। অপরাধীরা গ্রেফতারও হচ্ছেন। অবৈধ অস্ত্রের বিষয়ে সব সময়ই বিশেষ দৃষ্টি থাকে পুলিশের। যেহেতু সামনে নির্বাচন, তাই নির্বাচন সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে বিশেষ নজরদারি চলছে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে নির্বাচনি আচরণবিধি মেনে চলবেন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা।
তিনি আরও বলেন, মঙ্গলবার (আজ) নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে বিশেষ বৈঠক আছে। হয়তো কমিশন আরও কিছু নির্দেশনা দেবেন। পুলিশ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। গত ১২ এপ্রিল রাত আড়াইটার দিকে লক্ষ্মীপুর জেলা সদরের চন্দ্রগঞ্জের পাঁচপাড়া এলাকায় ছাত্রলীগের চার নেতা-কর্মীকে কোপানো ও গুলি করার ঘটনায় একজন নিহত ও তিনজন গুরুতর আহত হয়েছেন। নিহত এম সজীব চন্দ্রগঞ্জ কফিল উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন। আহত অন্যরা হলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী সাইফুল পাটওয়ারী, সাইফুল ইসলাম জয় ও রাফি। স্থানীয় থানা ছাত্রলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের শীর্ষ দুই নেতার বিরোধের জেরে এমন ঘটনা ঘটেছে বলছে পুলিশ। আহতরা চন্দ্রগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। চলমান বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাওয়া হয় র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল মাহবুব আলমের কাছে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিটি স্পর্শকাতর এবং জনগুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় বিশেষ দৃষ্টি দেয় র্যাব। এসব ঘটনায় অনেক সাফল্য সম্পর্কে সবাই অবগত। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও র্যাবের নজরদারির বাইরে নয়। বিশেষ করে অবৈধ অস্ত্রের বিষয়ে র্যাব সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব দেয়। র্যাব সব সময় অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখে। গত শনিবার সকালে গাজীপুর সদরের দেশিপাড়ায় জমি পরিমাপের কাজ করছিলেন হারুন অর রশীদ ও তার স্বজনরা। এ সময় শর্টগান হাতে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতিপ্রার্থী রাশেদুজ্জামান মাসুম জমির মাপজোক বন্ধ করার নির্দেশ দেন। নইলে প্রতিপক্ষ হারুনকে গুলি করে বুক ফুটো করে দেওয়ার হুমকি দেন তিনি। এ ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। গত ১৩ মার্চ নাটোর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফরহাদ আলী দেওয়ান ওরফে শাহীন (৪২) নাটোর আদালতে একটি রাজনৈতিক মামলায় হাজিরা দেওয়ার পর মোটরসাইকেলে করে সিংড়ার দিকে রওনা হন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের ফুলবাগান এলাকায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের কার্যালয়ের সামনে পৌঁছালে পেছন থেকে একটি মাইক্রোবাস তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মাইক্রোবাস থেকে দুর্বৃত্তরা নেমে লোহার রড দিয়ে তাকে পিটিয়ে বাঁ-হাত ভেঙে দেয়। পরে দুর্বৃত্তরা পরপর তিনটি গুলি করে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল?্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, আসন্ন উপজেলা নির্বাচন ঘিরে নানাভাবে সহিংসতা সৃষ্টি হচ্ছে। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, পেশিশক্তি ব্যবহার করে নির্বাচনি মাঠকে অস্থির করা, প্রার্থীদের মধ্যে কোন্দল ও অপহরণসহ নির্বাচনি মাঠ দখলে রাখার এক ধরনের অপচেষ্টা লক্ষণীয়। এ ছাড়া, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পছন্দের প্রার্থী বা আত্মীয়-স্বজনকে প্রার্থী করা নিয়ে সৃষ্ট দলীয় কোন্দল চরম পর্যায়ে হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।তিনি আরও বলেন, উপজেলা নির্বাচনকে দলীয়মুক্ত এবং দলীয় প্রতীক নিরপেক্ষ রেখে নির্বাচন করার সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে নির্বাচন পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট কাজে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ও শক্ত ভূমিকা পালন অপরিহার্য। অন্যথায়, সহিংসতা নানা মাত্রায় নানাভাবে বাড়তে থাকবে।