সোমবার ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২১শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভুয়া এনজিও উধাও

প্রকাশিতঃ ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪  

বিশেষ প্রতিবেদক, লক্ষ্মীপুর পৌর এলাকার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মুন্নি আক্তার একটি এনজিও সংস্থা থেকে আড়াই লাখ টাকা ঋণ নেওয়ার আশায় সোনার চেইন বন্ধক দিয়ে ১৮ হাজার টাকা তুলে দেন ওই এনজিও কর্মীর হাতে। তিনদিন পর অফিসে এসে দেখেন এনজিও সংস্থার কেউ নেই। অফিসে তালা ঝুলতে দেখেন তিনি। তাদের ব্যবহৃত মুঠোফোনও বন্ধ রয়েছে।

ঋণ তো দূরে কথা, মুন্নি আক্তারের মূলধন নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে ‘সাউথ প্যাসিফিক বিজনেস ডেভেলপমেন্ট’ নামের ওই সংস্থাটি।

মুন্নির প্রতিবেশি শাহিনুর বেগমও ব্যবসা করার জন্য ৩ লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে আগাম জমা দিয়েছেন ১৭ হাজার টাকা। তাদের এলাকার ৭ জন গ্রাহকের কাছ থেকে এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা আগাম হাতিয়ে নিয়েছে ওই এনজিও সংস্থার লোকজন।

ভবানীগঞ্জের চরভূতা গ্রামের নজরুল ইসলাম তার ছেলে বিদেশ পাঠাতে সেই এনজিও সংস্থাতে সাড়ে চার লাখ টাকা লোন প্রস্তাব করেন। এ জন্য জামানত বাবদ ওই এনজিওকে আগাম দিতে হয়েছে ৩৩ হাজার টাকা।

মুন্নি, শাহিনুর, নজরুল ইসলামের মতো এমন অন্তত তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ঋণ নেবার আশায় ওই এনজিও কর্মীদের হাতে টাকা তুলে দিয়েছেন। কেউ ধারদেনা করে, কেউ স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখে আবার কেউবা জমানো টাকা তুলে দিয়েছেন তাদের হাতে। সংস্থাটির কর্মীর হাতে বিভিন্ন অংকের টাকা জমা দিয়ে একইভাবে প্রতারিত হয়েছেন খোদেজা, মনিকা আক্তার, হাজেরা বেগম, নুর নাহার, বকুল বেগম, আক্তার জাহান, জোসন্না, রিয়াজ, আবুল কাশেম, সালেহা বেগম, ফাতেমা বেগম, শারমিন, জোৎনা, আজাদ, খোরশেদ আলম, হুমায়ুন কবির, হালিমাসহ অনেকে। তাদেরকে ঋণ দেবার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রলোভনে ফেলেছে একটি প্রতারক চক্র।

রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) এবং আগামীকাল সোমাবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) গ্রাহকদেকে ঋণের টাকা তুলে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রোববার সকালে এসে গ্রাহকরা দেখতে পান এনজিওটির অফিসে তালা ঝুলছে। কর্মকর্তা এবং কর্মীরা লাপাত্তা হয়ে গেছে। তাদের ব্যবহৃত ফোন নাম্বারও বন্ধ পান গ্রাহকেরা।

ঋণের প্রলোভনে পড়ে এখন সর্বশান্ত তারা। তাদের কাছ থেকে অন্তত অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে সংস্থাটি হঠাৎ উধাও হয়ে যায় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

জানা গেছে, প্রায় মাস খানেক আগে লক্ষ্মীপুর পৌর এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের গো-হাটা-তেরবেকি সড়কের পাশে লামচরী এলাকায় একটি ভবনের ফ্লাট ভাড়া নিয়ে ‘সাউথ প্যাসিফিক বিজনেস ডেভেলপমেন্ট’ নামীয় একটি এনজিও সংস্থা তাদের কার্যক্রম শুরু করেন। ভবনের দ্বিতীয় তলায় এনজিওটির নামে একটি সাইনবোর্ড ঝুলানো ছিল।

স্থানীয় লোকজন ও ভূক্তভোগী গ্রাহকরা জানায়, অফিসে তাদের ৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মী ছিল। এদের মধ্যে দুইজন নারী। তারা লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সাধারণ লোকজনকে ঋণের প্রলোভন দেয়। গত বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত জামানত হিসেবে প্রতিটি এলাকা থেকে এনজিওটি কর্মীর নামে প্রতারক চক্রটি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে তাদের আর কোন খোঁজ নেই। রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) থেকে গ্রাহকদের ঋণের টাকা দেবার কথা ছিল সংস্থাটির।

এদিন দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, অফিসের সামনে এখন শত শত গ্রাহক বিক্ষোভ করছে। এনজিওটির অফিস ছিল তিনতলা একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায়। ভবনের মূল ফটকে তালাবদ্ধ দেখা গেছে। ভবনের মালিককেও পাওয়া যায়নি। পাশেই এলাকায় ছিল ভবন মালিকের বাড়ি, বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

এনজিওর নামে প্রতারকেরা গ্রাহকদের হাতে শুধুমাত্র তাদের ভিজিটিং কার্ড এবং লিফলেট দিয়েছেন। তবে টাকা জমা নেওয়ার জন্য লিখিত কোন কাগজ দেননি। ভিজিটিং কার্ডে এনজিও নাম এবং ঢাকা অফিসের ঠিকানা দেওয়া রয়েছে। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে আব্দুল আসাদ (রাসেল) নামে একজনের নাম রয়েছে। সেখানে তার ব্যবহৃত নাম্বার হিসেবে ‘০১৩০২৬৬০১৭৮’ নাম্বারটি দেওয়া ছিল। আর প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া ছিল “হেড অফিস: ব্লক-সি, রোড নং-০৯, হাউজ নং-৪২০, কাকলী বনানী, মিলি সুপার মার্কেট সংলগ্ন, ঢাকা-১২৩০।” গ্রাহকদের কাছে দেওয়া এনজিওটির লিফলেটে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত এবং Reg. No.: S 1545/C 92189/22/C 78424/52’ উল্লেখ ছিল। এতে মো. শাহাদাত হোসেন নামে একজন মাঠকর্মী ও তার মুঠোফোন নাম্বার (০১৯২৩৯১৩০৬৬) লেখা রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতারকরা সুকৌশলে গ্রামের সহজ-সরল নারী-পুরুষদের সাথে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

পৌর এলাকার জেবি সড়কের বাসিন্দা ভূক্তভোগী কহিনুর বেগম বলেন, এনজিও সংস্থার একজন কর্মী আমাদের এলাকায় গিয়ে ঋণ দেবার কথা বলে। তারা যে শর্তগুলো দিয়েছে, খুব সহজ মনে হয়েছে। আমাদের দোকানের জন্য আমি ৫ লাখ টাকা ঋণ নিতে আগ্রহী ছিলাম। এ জন্য একহাজার ৫০ টাকা দিয়ে প্রথমে ভর্তি হই। এরপর ৫ লাখ টাকা ঋণের জন্য আগাম জামানত হিসেবে ৩০ হাজার টাকা জোগাড় রাখতে বলে। গত বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) ওই কর্মী আমাদের বাড়িতে গিয়ে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে আসে। রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) আমাকে ঋণের ৫ লাখ টাকা অফিস থেকে নিয়ে আসতে বলেছে। ঋণের সাথে ঋণ এবং জামানতের বইও ইস্যু করে দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু আজ (রোববার) অফিসে এসে দেখি তারা কেউ নেই।

সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের মোহাম্মদ নগর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল্লা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা এক গ্রুপে ১২ জন সদস্য ঋণের জন্য আবেদন করি। আমাদেরকে এক হাজার ৫০ টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হয়েছে। প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে নিয়েছে স্ট্যাম্প বাবদ। আর আমাদের ১০ জনের কাছ থেকে ঋণের জামানত বাবদ এক লাখ ৯৫ হাজার টাকা নিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে একজন কর্মী আমাদের বাড়িতে গিয়ে টাকাগুলো নিয়ে আসে, আজ রোববার আমাদের অফিসে আসতে বলেছে। এসে দেখি কেউ নেই।

একই এলাকার জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ৩ লাখ টাকা লোনের আশায় আমি ১৬ হাজার ৩০০ টাকা তুলে দিয়েছি। ধার করে টাকা নিয়েছি, আমাকে বলছে আজকে ঋণ দেবে। ঋণ পেয়ে ধারের টাকা পরিশোধ করতাম। কিন্তু আমাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। আমাদের টাকাগুলো নিয়ে তারা লাপাত্তা হয়ে গেছে। আমরা প্রশাশনের কাছে বিচার চাই। প্রতারকদের আইনের আওতায় এনে আমাদের টাকাগুলো উদ্ধার করা হোক।

লক্ষ্মীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাইফুদ্দিন আনোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, প্রতারণার তথ্য পেয়ে আমরা সেখানে গিয়েছি। তবে প্রতারকদের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। লিখিত অভিযোগ দিলে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।